"আমি জানি এইঘরে আমি ছাড়া আর কেউ নেই।
আমি একা এবং অবশিষ্ট আছি। জানিনা এর আগে কি হয়েছিল- কিনবা আমি জানাতে চাইনা। শুধু জানি আমি আজরাতে এই
ঘরে
একা এবং
অবশিষ্ট মানুষ। শুয়ে আছি আমার খাটে। আমার পাশেই বিশাল দেয়াল। আমি রাতের অন্ধকারে দেয়ালের ঠান্ডা
অস্তিত্ব টেরপাচ্ছি। টেরপাচ্ছি আমার পাশের মোলায়েম অথচ শক্ত কনক্রিট। সুতারাং আমার পেছন দিক থেকে কোন বিপদ আসার কোন
সন্দেহ
নেই যদিনা
কেউ দেয়াল ভেঙ্গে এসে গায়ের উপর পড়ে। কিন্তু আমার সমস্যা অন্যখানে। এইমুহুর্তে আমার মনে
হচ্ছে কেউ একজন কিনবা কিছু একটা আমার ঘরে আছে। আমি সেটাকে দেখতে পাচ্ছিনা। কিন্তু আমি টের পাচ্ছি। আমি ভীতু নই- তবে এখন ভয়
পাচ্ছি।
প্রচণ্ড ভয়
ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করেছে আমাকে। আমি জানিনা এর থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কি - শুধু
জানি
এই ভয় থেকে
পরিত্রাণ পেতে হবে আমাকে। কানের পাশে ঝা ঝা করতে শুরু করেছে। শুনেছি শরীর অসুস্থ হয়ে গেলে
কিনবা
দুর্বল হয়ে
গেলে এটা হয়। কিন্তু আমি তো দুর্বল নই- আমি সবল। গায়ে তাগড়া জোয়ানের শক্তি। নাইলে ওরা আমার সাথে পেরে উঠবেনা কেন? আমি তো ওদের কিছুই করিনি। ওরা আমার বিপক্ষে গেছিল- আমি ওদেরকে... । যাই হোক - এখন ব্যাপার হল আমার কানের
পেছনে কেমন একটা চিনচিনে শব্দ হচ্ছে। শব্দটা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। বাড়তে শুরু করেছে
আমার মাথার ভেতর। চিনচিন করতে করতে শব্দটা মিনিট খানেকের মাঝেই
এই কান থেকে ও কান ঘুরে আসল সতিনের ঘর বদলের মত। ও বলতে ভুলেই গেছি- আমি আরেকটা শব্দ শুনছি। সেটা হল একটা ক্যাও
ক্যাও
টাইপের
শব্দ। এই শব্দের জনক কে আমি তা জানিনা। এটা চিনচিন শব্দের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। কেউ যেন বসে বসে কিছু একটা
মন্ত্রের মত করে পড়ে চলেছে আমার বাম কানের পাশে। আমি বুঝতে পারছিনা একটা ফোঁটাও- শুধু বুঝতে পারছি -যেই
হোক-সে
প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে শক্তিশালী অবস্থানে
চলে যেতে শুরু করেছে। আমি ওকে থামাতে পারছিনা। কানে হাত দিয়ে থেকেছি। শুধু মনে হচ্ছে আমার
বিছানার নিচ থেকে কেউ একজন টানা কিছু একটা বলে চলেছে- আর আমি সেটাকে আটকানোর বৃথা চেষ্টা করছি। আমার বিছানার নিচে কিছু নেই। একেবারেই
ফকফকা। আমি জানি- এই ফকফকা থাকাটাই আমার জন্য কাল হল। এখানে এখন গেড়ে বসেছে কিছু একটা। কেউ একজন। তাকে
লিঙ্গ
বাচক শব্দে
আটকানো গেলে মন্দ হোতনা। কিন্তু যাচ্ছেনা। অবশ্য তাকে একভাবে আটকানো যাচ্ছে। সেটা হল আমার খাটের
সাথে দেয়ালের দূরত্ব এতই কম যে- সে কোন ভাবেই ওখান দিয়ে উঠে আসতে পারবেনা যদিনা সে রাবারের
কিছু একটা হয়। আচ্ছা
অশরীরির কি শরীর আছে? থাকলে
কি রকম? জানিনা। মনে হচ্ছে ফেটে যাবে মাথাটা। উফফ- কি
অদ্ভুত। শব্দটা বেড়েই চলেছে। এই সময় খুট করে শব্দ হল আমার ঘরের মাঝেই কোথাও। শব্দটা আমি শুনলাম। একেবারেই স্পষ্ট। এবং পরিষ্কার। এই
শব্দ মানুষের পায়ের শব্দ। একেবারে নিঃশব্দে হাটার সময় মানুষের পা থেকে এই শব্দ তৈরি হয়। আমি জানি-
কারণ
ছোটবেলা
আমি রান্না ঘর থেকে বৈয়াম নিয়ে আঁচার চুরি করে খাবার সময় আমার পা থেকে এই শব্দ হত। আর আমার মা এই শব্দ
শুনেই জেগে উঠতেন। আমি এর পরেই বেধরক মার খেতাম। এই শব্দ আমার খুব পরিচিত। আমি জানি এটা
পায়ের শব্দ। তার মানে কেউ একজন ঘরের মাঝে আছে। আমি জানি সে আছে। কিন্তু আমি তাকে দেখতে পাচ্ছিনা। ও আচ্ছা আমি তো আবারো ভুল করলাম। আসলে
আছে দুইজন। একজন আমার খাটের তলায়- আরেকজন আমার ঘরের অন্য কোনায়। আমি যেখানে শুয়ে আছি তার থেকে বেশ
খানিকটা
দূরে। ভয়ে আমার আত্মারাম খাচা থেকে উড়ে
যাবার যোগার। আমি ভয়ের চোটে আমার পেছনের দেয়াল টা অনুভব করার চেষ্টা করলাম। আহ্ - শীতল-
মোলায়েম - এবং দৃঢ় সে। আমার চাইতে অনেক বেশি দৃঢ়। আমার চাইতে অনেক বেশি মজবুত। আমার চাইতে
অনেক
বেশি
বিশ্বস্থ। আমি তো আমার বন্ধু কেই... । সে যাই হোক- এখন ঐ সব কথা বলার সময় না। আমি এখন নিজেকে
ঠিক রাখার দায়িত্ব নিয়েছি।
আমাকে ঘুমাতে হবে। কারণ আজকের রাত না ঘুমালে আমি মরে যাব। টানা চার রাত আমি জেগে আছি এই ঘরের ভেতর।
একেবারেই বন্দী দশা। বাইরে যাবার উপায় নেই। দশা। আকাশ দেখার উপায় নেই। নাহ- আমাকে কেউ বন্দী করে রাখেনি। আমি নিজেই যাইনি। আমার যেতে ভালো লাগেনা।
কারন মানুষ দেখলেই আমার... আমাকে ঘুমাতে হবে। আমাকে ঘুমাতে হবে ।আমার ঘুম আসবেই... কিন্তু ঘুম তো আসেনা। যখনই ঘুম না
আসার কথা মনে আসে- তখন ঘুম আরো বেশি করে পালায়। চারদিন ধরে আমার তাই হচ্ছে। আমার পেটে খিদে নেই-
কারণ আমার পেটে এখন.........
।
আমার শরীর
সুস্থ-কারণ আমি খেয়েছি...... কিন্তু মাথা ফেটে যাচ্ছে। এর কারণ কি আমি জানিনা। আমাকে কেউ জানায়
নি। আমি
কারো কাছেই
জানতে ও চাইনি। শুধু জানি আমাকে ঘুমাতে হবে। ঘট করে আরেকটা শব্দ হল। এবং আমি বুঝতে পারলাম- আমার
ঘরের মাঝে কিছু একটা- না না কিছু দুইটা অবশ্যই আছে। এবং ভাল ভাবেই আছে। এবং আমাকে এরা
ঘুমাতে
দেবেনা।
আচ্ছা এরা যদি ওরা হয়? তাহলে
তো আমি শেষ। কারণ আমি তো ওদের কে হজম করে ফেলেছি! এখন কি হবে? এখন আমি কিভাবে হজম করবো? শুনুন- আমাকে পাগল ভাববেন না। আমি
পাগল নই। সুস্থ মাথায় সুস্থ মস্তিষ্কে আমি দুইজন- হ্যাঁ - দুইজন মানুষকে হত্যা করেছি। কারন
ওরা আমার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছিল। কিন্তু আমি ওদের ক্ষমা ও করে দিতে পারতাম। আমি ওদের
ক্ষমা
করিনি-
কারন ওরা বোঝুক বিশ্বাসঘাতকতার মূল্য জীবন দিয়েও শোধ করা যায়না। আমি ওদের খুন করেছি। নিজের হাতে খুন
করেছি। ছুড়ি দিয়ে টুকরো টুকরো করেছি।তারপর... তারপর আমি ওদেরকে একেবারেই ভ্যানিশ করে দিয়েছি। কিভাবে জানেন? সে এক ইউনিক উপায়। আমি ওদের ...... আসলে আমি যে ফ্ল্যাটে আছি সেখানে
খাবারের বড় অভাব। আমার টাকা ছিল- কিন্তু সেই টাকা খরচ করার কোন উপায় ছিলনা। আমি ডাকাতি করে
এনেছিলাম সেগুলো। আমার সাথেই ছিল আমার দুই প্রাণপ্রিয় বন্ধু। আমি ওদের সহায়তায় টাকাগুলো
যোগাড়
করি। তারপর
পালিয়ে এখানে আসি। পুলিশ আমাদের খুঁজছে। আর আমাদের টাকা গুলোর নাম্বার ওগুলো সব পুলিশের হাতে চলে গেছে অনেক
আগেই। এখন আমরা ফেরার বুঝার পরই ওরা দুইজনে মিলে আমাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। আমি বুঝে ফেলি যখন আমি আবিদের হাতে
একটা চকচকে ছুড়ি দেখি। আমি এটা আগে ও অনেকবার দেখেছি। আমরা যখন সামাদ কে খুন করেছিলাম তখন
আমি সেই ছুড়িটাই আবিদের
হাতে দেখেছিলাম। এবং সাথে সাথে প্রথমে আবিদের গলা কেটে আলাদা করে ফেললাম। তারপর আবিরের শরীর টা দুইভাগ
করে ফেললাম। আমার মাথায় কোন টেনশন ছিলোনা। আমি শুধু আমার বেঁচে থাকার উপায় বের করেছি মাত্র। কারন আমি
ওদের না
মেরে ফেললে
আমাকে মেরে ফেলতো- আর আমার টাকার ভাগটা নিয়ে ভেগে যেতো এখান থেকে। কিন্তু আমি তার আগেই ওদের খতম
করে দিয়েছি। অবশ্য
এতে আমার অনুশোচনা হয়নি তা নয়। আমার মনে হয়েছে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। আমার নিজের জন্যই। আমি এই টাকা
গুলো ব্যাংক থেকে চুরি করেইছি শুধু মাত্র আমার জীবন টাকে সুন্দর করার জন্য। অবশ্য আমি এগুলো টানা দুই সপ্তাহ
খরচ
করতে
পারবোনা জানতাম। তবে এরকম বিপদে পড়ে যাবো ভাবতে পারিনি। কারণ এর পরেই আমি বেশ কয়েকবার এলাকায় পুলিশ টহলের
শব্দ শুনেছি। পুলিশ হয়তো কোন না কোন ভাবে টের পেয়ে গেছে। আমি ওদের নাগালের ভেতরে আছি ভাবতেই আমার শরীর ভয়ে... । ঘরে কোন খাবার ছিলোনা। ছিল শুধুই
ট্যাপের পানি। আমি একটাদিন পুরোটাই পানি খেয়ে কাটালাম। কিন্তু আমার পেট- পেট তো নয় কুয়া। খালি
খাই খাই করে আমাকে যন্ত্রণা
দেয়।
আমার অবশ্য
সমস্যা হয়নি। পরের দিনেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। আমাকে বের হতে হবে এখান থেকে। কিন্তু বেরিয়েই
আমি দেখি আমার ছবি পোষ্টারে টানানো। সাথে আমার দুই বন্ধুরো। আমার যা বোঝার সব বুঝে ফেলি। তারপর আবার ঘরে
চলে
আসি। এতই
ভয় পেয়েছিলাম যে আমি নিজের জন্য খাবারটা পর্যন্ত কিনে খেতে পারিনি। আমি জানতাম আমি টাকা গুলো
থেকে একটা বের করলেও ধরা পড়ে যাব। তারপর আমাক কেউ রক্ষা করতে পারবেনা। কারন আমার মামা চাচারা
কেউ এখানে নেই। সব পরপারে
চলে গেছে। সুতারাং আমি ফিরে এলাম। এবং তারপরেই আমার মাথায় আসল অন্য কিছু। আমি দেখলাম আমার পেট খিদেয় মরে যাচ্ছে। আমার শরীরে এক
ফোটা শক্তি নেই। অথচ ঘরের মাঝে আস্ত মাংস পড়ে আছে... কি? ঠিক ধরেছেন- ঐ যে আমার বন্ধুরা। ওদেরদুইজনকে আমি রেখেছিলাম ঘরের মাঝেই
একটা বাথরুমে। সেখানে গিয়ে সামান্য পচতে শুরু করা আবিদ আর আবিরের লাশ দুটোকে টুকরো টুকরো করে ধুয়ে
ফেললাম।
রান্না ঘরে
যাবতীয় মশলা ছিল। আমি সেগুলো দিয়েই কোন রকমে রান্না করে খেয়ে নিয়েছি আবিরের রান টা। এর পর কেটে
গেছে চার চারটি দিন। আমি দিব্যি এই ঘরের মাঝে ঠিকে আছি। খিদে পেলেই মাংস খাই। বিশ্বাস ঘাতকের
মাংস। খুনে বন্ধুদের মাংস। এই মাংস খাবার মাঝে ও প্রতিশোধের নেশা আছে। আমি বুঝতে পারি
এটা। বেশ
ভালোভাবেই
বুঝতে পারি। এবং বুঝি বলেই খেয়েছি। নাহ- আর শুয়ে থাকা যাচ্ছেনা। একটু আগেই খাবার খেয়েছিলাম। এখন আবার
খিদে
লেগেছে।
আমি নিয়ম করে খাই। কিন্তু এখন আবার খিদে লেগেছে। কেন? উফ- কানের পাশে চিনচিনে শব্দ আরো বেড়েছে। আমাকে
হয়তো আবারো খেতে হবে। আমি বলেছিলাম না- শরীর দুর্বল হয়ে গেলে এটা হয়। সব আমার মনের কল্পনা। আমি সব কিছু
কল্পনা
করেছি। কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। সব আমার মনের
কল্পনা। সব আমি কল্পনা করেছি। ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠতে যেতেই আমার পায়ে কিছু একটার স্পর্শ
পেলাম।
জিনিসটা
ফুটবলের মত। শেষ কবে ফুটবল খেলেছিলাম মনে নেই। কিন্তু আমার খাটের নিচে ফুটবল ছিলো কি? বেশ ঠান্ডা আর স্যাঁতস্যাঁতে। আমি
হাতড়ে গিয়ে আলোটা জ্বালাতেই
টের পেলাম জিনিসটা কি। সেটা আর কিছু না আবিদের মাথা। আমি এটাকে এখানে নিয়ে আসিনি। ফ্রিজে রেখেছিলাম।
কিন্তু এটা এখানে এলো কিভাবে? উফফ- আমি ভুল দেখছি। কারণ মাত্র দেখলাম কাটা মুন্ডুটার চোখ দুটো কেঁপে
উঠল
সামান্য।
আমি দেখেছি- তবে ভুল দেখেছি। এটা হতে পারেনা। আমার বুকের ভেতর ভোঁতা হৃদয় লাফাতে শুরু করেছে। গায়ের
সব লোম স্যাত করে দাঁড়িয়ে গেছে কবেই। এখন যেন উড়ে চলে যেতে চাইছে মহাকাশে। আমি ভুল দেখছি।
নির্ঘাত ভুল দেখছি। এটা হতে পারেনা। হতে পারেই না কোন কালে। একটা মরা মানুষের কেটে ফেলা মুন্ডুর চোখ এভাবে খুলে যেতে পারেনা। না – না নাআআআআআআআআআআআআআআআ।" ………………………………. ডায়েরিতে এর বেশি কিছু লেখা নেই।
লেখাটা পুরোটা পড়ে ইন্সপেক্টর উজ্জ্বল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সবে মাত্র ডাকাতটার ঘর তল্লাসি করে
তার লাশ পাওয়া গেছে। ভয়ার্ত এবং ভয়ানক একটা লাশ। লাশের এখানে ওখানে নানা রকম দাগ। কেউ ছিড়ে
খুঁড়ে আহত করেছে। আর হাতে লেখা এই ডায়েরিটা পড়ে পুলিশ ফ্রিজ থেকে উদ্ধার করেছে দুটো লাশ।
আর
অনেক গুলো
টাকা।
পুলিশ
জীবনে ও এই ফ্ল্যাট খুঁজে পেতনা। কিন্তু কে একজন এই ঘরের ফোন লাইন থেকে ফোন করে বলেছে এখানে ওরা আছে।
ওদের তিনজনকেই পাওয়া যাবে। ওদের তিনজনকেই পাওয়া গেছে। দুইজন আধা খাওয়া হিসেবে। আরেকজন মৃত-
সম্পূর্ন
দেহে।
কিন্তু ঘরের ভেতরের সেই মানুষটাকে আর খুঁজে পায়নি ইনস্পেক্টর উজ্জ্বল ;যে ফোন করে বলেছিল “ওরা এই ঘরেই আছে”।
0 মন্তব্য:
Post a Comment