বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিতে নৃত্য-গীতের প্রচলন এবং
প্রসারের সূচনা সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই। নৃত্য-গীতের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো মোহনীয়
শব্দ বা ‘বাদ্য’। কোন বস্তুতে আঘাত করলে যে সুরের আবেশ যুক্ত ধবনি তৈরি
হয় তাই ‘বাদ্য’। আর যে যন্ত্র থেকে এই সংগীতের উপযোগী ‘বাদ্য’ তৈরি হয় তাকেই বলে বাদ্যযন্ত্র।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলায় বাদ্যযন্ত্রের
ব্যবহারের ইতিহাস অনেক প্রাচীন, সেই প্রাচীনত্বের প্রমাণ আমার পাই বিভিন্ন
প্রত্নতাত্বিক এবং সাহিত্যিক উৎস থেকে। নওগার পাহারপুড় (খ্রীঃ ৮-১২শতক), কুমিল্লার
ময়নামতিতে (খ্রিঃ ৭-১২ শতক) প্রাপ্ত পোড়ামাটির ফলক ও পাথরের ভাস্কর্যে উৎকীর্ন
নানা মানব বা দেব-দেবীর মূর্তির সাথে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, যেমন-কাঁশর, করতাল,
ঢাক, বীনা, বাশি, মৃদঙ্গ ও মৃৎভান্ড ইত্যাদির উপস্থাপন লক্ষ করা যায়।
খ্রিঃ একাদশ শতকে রচিত বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন
চর্যাপদে গীত-নৃত্য-বাদ্যের বর্ণনা রয়েছে। চর্যার তিনটি পদে মোট সাতটি
বাদ্যযন্ত্রের নাম উল্লেখিত হয়েছে, এগুলো হলো বীণা, পটহ, মাদল, করণ্ড, কসালা, দুন্দুভি ও ডমরু। খ্রিঃ ত্রয়োদশ শতকে রচিত “শূন্যপুরাণে’ পূজার উপলক্ষে ব্যবহত ঢাক, ঢোল, কাড়া, মৃদঙ্গ, মন্দিরা, ডমবরূ, দুন্দুভি, বরঙ্গ, ভোর, ধীরকালি,শঙ্খ, শিঙ্গা, ঘ্ম্টা, জয়ঢাক, দামামা, খমক প্রভৃতি বিয়াল্লিশ ধরনের বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ
রয়েছে। হিন্দু ধর্মের বিকাশের
ধারায় বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেবতার জনপ্রিয়তা বাঙ্গালি সমাজে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এরই
ধারাবাহিকতায় চৌদ্দ শতকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের যে প্রবল জোয়ার সমাজে তৈরি হয়েছিল তাতে
মুরলী বা মোহনবাঁশি, করতাল ও মৃদঙ্গের ব্যাপক ব্যবহারের কথা জানা যায়; এর মধ্যে শেষের দুটিকে কৃষ্ণের নাচের বাদ্যযন্ত্র বলা
হয়েছে। পরবর্তীতে ষোলো
শতকে শ্রী চৈতন্যের নব্য বৈষ্ণব আনন্দলনের প্রভাবে কীর্তন আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ
সময়ে প্রধান বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার হতে দেখা যায় খোল, করতাল ও মন্দিরা।
অন্যদিকে মধ্যযুগে উপমহাদেশে মুসলমান শাসকদের আগমেনের
ফলে প্রচলিত ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম সংস্কৃতির সংমিশ্রন ঘটে
এবং ক্রমাগত নিত্যনতুন সংযোজনের মধ্য দিয়ে সঙ্গীত কেন্দ্রিক বিনোদনের নতুন নতুন
রূপ প্রকাশিত হতে থাকে, সেই ধারা থেকে বাদ পরেনি বাদ্য যন্ত্রও। সানাই ও নহবত
জাতীয় যন্ত্র মুসলমানদের অবদান।
পরবর্তীকালে ইংরেজ শাসনামলে এদেশে সঙ্গীত ও
বাদ্যযন্ত্রের উপরে ব্যাপক পাশ্চাত্য প্রভাব পরতে দেখা যায় এবং বর্তমানে বহুল
ব্যবহৃত হারমোনিয়াম, বেহালা, গিটার, বিউগল, ব্যঞ্জো ইত্যাদি সেই পাশ্চাত্যের প্রভাবেরই ফসল।
তবে শুধু মাত্র সঙ্গীতেই নয়, বিভিন্ন শোভাযাত্রা,
শবযাত্রা, যুদ্ধযাত্রা ইত্যাদিতে সেই প্রাচীন কাল থেকেই বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার
লক্ষনীয়। সুদূর অতীত থেকেই বাদ্যযন্ত্র নানা ভাবে বাংলার মানব জীবনের নানা অংশকে
স্পর্শ করে রেখেছে- হিন্দুধর্মালম্বীগণ ঢাক, ঢোল, কাঁসি বাজিয়ে শোভাযাত্রা করছে,
মুসলমানদের মহররমের মিছিল থাকছে ঢোল, কাড়া, কাঁসার বাদ্য, যুদ্ধ যাত্রায় ব্যবহার
হয়েছে সিঙ্গা, নাকাড়া এমনকি বিভিন্ন পেশাজীবীরা তাদের পেশাকে আকর্ষণীয় করার কাজে
ব্যবহার করছে বাদ্য যন্ত্রের- যেমন –ঢুগঢুগি বাজিয়ে বানার নাচ দেখানো কিংবা বীন বাজিয়ে সাপ
খেলা দেখানো। বাদ্যযন্ত্র স্থান পেয়েছে বাংলার লৌকিক বিশ্বাসেও; যেমন ‘রাতের বেলায় ঘরে বসে বাঁশি বাজালে ঘরে সাপ
বা ইঁদুর আসবে’। সেই সাথে বাদ্যযন্ত্রকে নিয়ে তৈরি হয়েছে বিশেষ
পেশাজীবী শ্রেনী।
সাধারণভাবে বাংলার মানুষ একদম লোকজ, সহজপ্রাপ্য
দ্রব্যাদি দিয়েই তৈরি করতো এসব বাদ্যযন্ত্র। লাউ, কুমড়োর খোল, নারিকেলের মালা,
মাটির হাড়ি, কলসি, চামড়া, বাঁশ, কাঠ ইত্যাদিই ছিল বর্নাঢ্য এসব বাদ্যযন্ত্র তৈরির
উপাদান।
তবে কালের পরিক্রমায় ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র গুলোর
অনেকগুলোই হারিয়ে গেছে বা যেতে বসেছে।
গঠন ও উপাদানগত দিক
থেকে ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রে বাদ্যযন্ত্র সমূহকে তত(তার যোগে যে বাদ্য বাজে), শুষির (ফুঁ দিয়ে যে বাদ্য বাজে), ঘন (ধাতু দিয়ে তৈরি বাদ্যযন্ত্র) ও
আনদ্ধ (চর্মাচ্ছাদিত বাদ্যযন্ত্র) এই চার শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। বাংলাদেশের আবহমান
বাদ্যযন্ত্র সমূহকে এই চার শ্রেণীতে নিম্নোক্ত ভাবে সাজানো যায়-
১. ততঃ একতারা, দোতারা, সারিন্দা, বীনা, ডুগডুগি
ইত্যাদি।
২.শুষিরঃ বাঁশি, শঙ্খ, সানাই, আম আঁটির ভেঁপু, শিঙ্গা।
৩.ঘনঃ কাঁসর, কাঁসা, করতাল, মন্দিরা, ঘন্টা, খঞ্জনী
ইত্যাদি।
৪. আনদ্ধাঃ ঢাক, ঢোল, জয়ঢাক, মাদল, মৃদঙ্গ, খোল, ডুগি
ইত্যাদি।
এবার তাহলে দেখে নেয়া যাক বাংলায় বহুল ব্যবহৃত
ঐতিহ্যবাহী কিছু লোকজবাদ্য যন্ত্রকে--
একতারাঃ
বাঊল গানের সাথে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক যে যন্ত্রটির তার
নাম একতারা। লাউ বা পাকা মিষ্টি কুমড়োর খোলের সাথে তার সংযুক্ত করে তৈরি করা হয় এই
যন্ত্রটি। এর তারের সংখ্যা একটি থাকায় নাম হয়েছে একতারা’।
নির্মান উপকরণ এবং গঠনভেদে একতারার একাধিক নাম পাওয়া
যায়, যেমন- গোপযন্ত্র, থুনথুনে, বাসমতি ইত্যাদি।
দোতারাঃ
জারী, মুর্শিদী ও কবিগানে বহুল ব্যবহার দেখা যায়
দোতারার। দোতারা প্রাচীনত উল্লেখ পাওয়া যায় পনের শতকে রচিত পদ্ম
পুরানে। লম্বা ‘ডই’ আকারের কাঠের সাথে চামড়া যোগ করে তৈর হয় যন্ত্রটি
এবং এতে তারের সংখ্যা থাকে চারটি। এই চারটি তারের মধ্যে শুধু দু’টি তার ব্যবহার করা হয় বলেই এর নাম হয়েছে
দোতারা।
সারিন্দা তৈরি করা হয় কাঠ দিয়ে, এর পেটের কাছটা কিছুটা
চওড়া এবং চামড়া দিয়ে ঢাকা থাকে, বাকি অংশ ফাঁকা। এতে ঘোড়ার লেজের তিনটি তার যুক্ত
থাকে। বিচার এবং মুর্শিদী গানে সারিন্দার ব্যবহার করা হয়।
ডুগডুগিঃ
ডুগডুগির অপর নাম ডমরু, শাস্ত্র অনুযায়ী এটি হিন্দু
দেবতা শিবের বাদ্যযন্ত্র। সাধারণত
শিবের গাজন, সাপখেলা, বানর নাচ ও ভল্লুকের খেলায় ডমরু ব্যবহৃত হয়। বাদ্যযন্ত্রটি ছোট, সরু মধ্যভাগে রশি পেঁচানো থাকে।
রশির দুই প্রান্তে থাকে দুটো সিসার গুলি। বাদ্যটির মধ্য ভাগ ধরে নাড়ালে এই গুলি
দুই প্রান্তের চামড়ায় লেগে শব্দ তৈরি করে।
বাঁশিঃ
বাংলার প্রাচীনতম এবং জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র গুলোর মধ্যে
অন্যতম হলো, বাঁশি। মুলতঃ গানের সাথে বাজানো হয় এটা। তরলা বাঁশ দিয়ে তৈরি
বাঁশির আকার ও প্রকারভেদে
বাঁশির বিভিন্ন নাম আছে, যেমন: আড়বাঁশি, কদবাঁশি, টিপরাবাঁশি, হরিণাবাঁশি
ইত্যাদি।
মু্রলী বা আড় বাঁশিঃ
মুরলিকে কৃষ্ণের বাদ্যযন্ত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। এই
বাঁশির জন্যই কৃষ্ণের অপর নাম মুরলিধর। প্রায় এক হাত লম্বা মুরলিতে ছিদ্র থাকে
সাতটি। বেশির ভাগ লোক সঙ্গীতে এবং কীর্তনে মুরলির আবশ্যক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
এর অপর নাম আড় বাঁশি।
কদবাঁশিঃ
কাদ বাঁশি মুখের মধ্যে পুরে বাজাতে হয়, এই
কারণে উত্তরবঙ্গে একে বলা হয় ‘মুখাবাঁশি’,। আবার বাঁশিটির মুখের কাছে খিল থাকে বলে ফরিদপুরে ‘খিলবাঁশি’ এবং বাঁশির মুখের
দিকটা কলমের মতো দেখায় বলে ‘কলমবাঁশি’ও বলা
হয়।
তুবড়ি বা বীনাঃ
সাপুড়েরা সাপের খেলা দেখাতে যে বাঁশিটি আবশ্যিকভাবে ব্যবহার
করে সেটার নামই তুবড়ি বা বীনা। ছোট লাঊয়ের খোলের মধ্যে এক জোড়া বাঁশের নল যুক্ত
করে তৈরি করা হয় তুবড়ি।
সানাইঃ
সানাই মাঙ্গলিক বাদ্য যন্ত্র অর্থাট যে কোন শুভ কাজে
মঙ্গল কামনা করে বাজানো হয় সানাই। কাঠ ও পিতলের তৈরি সানাই এর এদেশে আগমন ঘটে
মধ্যযুগে মুসলিম শাসকদের হাত ধরে। সাধারণ মুসলিম বিবাহ অনুষ্ঠান ও ঈদ শোভাযাত্রায়
সানাই বাজানো হয়।
শাঁখঃ
শঙ্খ বা শাঁখ একটি অতি
পরিচিত ও
প্রাচীন শুষির যন্ত্র। হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর বাদ্য যন্ত্র
মনে করা হয় শাঁখকে। এটিও মাঙ্গলিক বাদ্য যন্ত্র, হিন্দুদের পূজা-পার্বণ, বিবাহ ইত্যাদি মাঙ্গলিক ও প্রাত্যহিক অনুষ্ঠান শাঁখ ব্যবহৃত হয়।
সমুদ্র থেকে আহৃত
শঙ্খের ভেতর-বাইর পরিস্কার করে
এবং তার নাভি কেটে সেখানে ফুঁ দিয়ে বাজানো
হয়।
শিঙ্গাঃ
বাদ্যযন্ত্র হিসেবে শিঙ্গার উপস্থিতিও অনেক প্রাচীন, হিন্দু দেবতা শিবের বাদ্য
যন্ত্র হিসেবে গন্য করা হয় একে। প্রাচীনকালে
শিঙ্গা যুদ্ধের বাদ্যযন্ত্র ছিল, তাই এর অপর নাম রণশিঙ্গা। আগে অতীতে
মহিষের শিং থেকে তৈরি হতো শিঙ্গা; বর্তমানে
ধাতু নির্মিত শিঙ্গা ব্যবহৃত হয়। বড়
আকারের শিঙ্গাকে বলা হয় রামশিঙ্গা; এগুলি পেতল বা তামার
আমআটির ভেঁপুঃ
গ্রামের শিশুদের প্রিয় বাদ্যযন্ত্র আম আটির ভেঁপু। অংকুর গজানো আমের আঁটির
খোসা ছাড়িয়ে জোড়া বিচিটা তেরছাভাবে
সামান্য ঘষে তৈরি করা হয় এটি। তেরছা
অংশ মুখে পুরে ফুঁ দিলে পুঁ পুঁ শব্দ তৈরি হয়, এ থেকেই এর নাম হয়েছে
ভেঁপু।
কাঁসর এবং কাঁসিঃ
ঘনযন্ত্র বাদ্যযন্ত্রের
মধ্যে প্রধান হলো কাঁসর, এটিও বাংলার একটি প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র । এটি কাসা দিয়ে তৈরি সামান্য কানাতোলা থালার মতো আকারের একটি বাদ্যযন্ত্র। এই বাদ্যযন্ত্রের মাথায় দুটি ছিদ্র থাকে, এখানে দড়ি বেঁধে বাম হাতে ঝুলিয়ে ডান হাতে কাঠির সাহায্যে বাজানো হয়। হিন্দুদের
পূজামণ্ডপে ঢোলের সঙ্গে কাঁসরও বাজানো হয় আবশ্যক ভাবে।
কাসরের চাইতে সামান্য ছোট একই আকারের যন্ত্রকে বলে কাঁসি। কাসির ধবনি কাসরের চাইতে তীব্র।
মন্দিরাঃ
মন্দিরা কাঁসার তৈরি দুটি
বাটি,
যার মাঝখানে ছিদ্র করে মোটা সুতায় বেঁধে
দুহাতে ধরে পরস্পরের মুখে টোকা দিয়ে বাজানো
হয়। মান্দিরা বাজানোর
সময়ে বাটির গা স্পর্শ করা
যায় না; কারণ তাতে ধ্বনি অস্পষ্ট ও বিকৃত হতে পারে। লোকসঙ্গীত
ও উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে জুডি়র ব্যবহার আছে।
করতালঃ
বৈষ্ণব সংকীর্তনে খোলের অনুষঙ্গ হিসেবে করতাল ব্যবহারের কথা জানা যায়। করতাল পেতলের তৈরি ছোট থালার আকৃতিবিশিষ্ট একটি যন্ত্র; এর বাদনরীতি মন্দিরার মতোই। করতালের
সুতা বা দডি় তর্জনীতে জড়িয়ে হাতের
তালুতে চাপ ও
ছাড় এটি বাজাতে হয়।
খঞ্জনী এবং ডফঃ
জারি ও ঘাটু নাচ-গানের
আসরে ঢোলের সঙ্গে এটি বাজানো হয়। খঞ্জনীর মতোই আরেকটি বাদ্যযন্ত্র আছে যা ডফ বা ডমজ্ঞ নামে পরিচিত। তবে
ডফ আকারে অপেক্ষাকৃত বড়। মুসলমানরা
এদেশে ডফ আমদানি করেছিল।
ঢাকঃ
বাংলার প্রাচীনতম বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে অন্যতম প্রাধান ও
জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র হলো ঢাক। হিন্দুদের পুজো
অনুষ্ঠানে ঢাক বাজানো বাধ্যতামূলক। ঢাক’কে কেন্দ্র
করে বাংলা সাহিত্যে অনেক প্রবাদবাক্যেরও সৃষ্টি
হয়েছে, যেমন: ‘ধর্মের
ঢাক আপনি বাজে’, ‘নিজের ঢাক নিজেই পেটানো’ ইত্যাদি। এমন কি আমাদের রাজধানী ‘ঢাকা’ নামের ইতিহাসেও ‘ঢাক’ বাদ্যযন্ত্র জড়িত আছে।
ঢাকা সাধারণত তিন বা সাড়ে তিন হাত বড় আকারের কাঠের খোলের উভয় মুখে পুরু চামড়ার
ছাউনি দিয়ে
ঢেকে ঢাক তৈরি করা হয়। মুখের ব্যাস হয় ১২/১৫ ইঞ্চি। মাটিতে
রেখে কিংবা মোটা ফিতার সাহায্যে
বাম কাঁধে থেকে কোমরের কাছ বরাবরঝুলিয়ে দুই হাতে কাঠির সাহায্যে এটি বাজাতে হয়।
জয়ঢাকঃ
জয়ঢাক যুদ্ধ যাত্রায় ব্যবহার করা হতো। জয় ঢাকের খোল
চওড়া, দুই দিকে চামড়ার আচ্ছাদনে মোটা কাঠ দিয়ে এটি বাজানো হয়। বর্তমানে সেনাবাহিনী মার্চ-পাস্টের সময় জয়ঢাক বাজানো হয়।
ঢোলঃ
সঙ্গীত ও নৃত্যকলায়
তালবাদ্য হিসেবে ঢোলের ব্যবহার ব্যাপক। কবি, যাত্রা, জারি, গম্ভীরা, আলকাপ
প্রভৃতি গানে অন্যান্য যন্ত্রের সঙ্গে ঢোলও বাজে। এছাড়া পূজা, বিবাহ, মুহররমের শোভাযাত্রা, লাঠিখেলা, কুস্তির
আখড়া সর্বত্র ঢোল বাজানো হয়, বলা যায় বাদ্য যন্ত্র হিসেবে ঢোলের ব্যবহার সার্বজনীন।
ঢোল, ঢাকের চাইতে আকারে
ছোট এবং
গঠন এবং শব্দে একটু ভিন্নতা রয়েছে। মোটা এবং ফাপা কাঠের খন্ডের দুই প্রান্তে চামড়া লাগিয়ে
তৈরি করা হয় এটি।
ঢোল বাজাতে ডান হাতে
একটি কাঠি ব্যবহার করা হয় আর বাম
হাতের তালু দিয়ে অন্যপ্রান্ত বাজানো হয়। ঢাকের চাইতে ঢোলের ধবনির ঘনত্ব
বেশি।
খোলঃ
চৈতন্যভগবতে শ্রী চৈতন্যের খোল, করতাল এবং মদঙ্গ নিয়ে
সংকীর্তন করার কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্তমানেও কীর্তন গানের আবিশ্যিক বাদ্যযন্ত্র
হলো খোল। মাটি বা কাঠ দিয়ে তৈরি মোচাকৃতির খোলের উভয় মুখে চামড়া লাগিতে এবং
চামড়ার টানা দিয়ে বেঁধে খোল তৈরি করা হয়। এর এক প্রান্ত খুব সরু অন্য প্রান্ত চওড়া
হয়। ফিতার সাহায্যে গলায় ঝুলিয়ে অথবা মাটিতে রেখে বসে খালি হাতে খোল বাজানো হয়। এর ধবনি ঢোলের চাইতে লঘু।
মৃদঙ্গ:
খোলের মতো মৃদঙ্গও একটি প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র, শূণ্যপুরানে এর উল্লেখ
পাওয়া যায়। বর্তমানে কীর্তন গান ও মণিপুরী নৃত্যের সঙ্গে এই যন্ত্রটি বাজানো
হয়। মৃদঙ্গ, খোলেরই একটি প্রকারভেদ, মাটির তৈরি বলে খোলের শাস্যীয় নাম ‘মৃদঙ্গ’। এর ডান পাশের মুখটি ছোট এবং বাম দিকের
মুখ অপেক্ষাকৃত বড়। বাদনরীতি খোলের মতোই।
মাদলঃ
মাদল আদিবাসী সাঁওতালদের একটি জনপ্রিয়
বাদ্যযন্ত্র। এটিও বাংলার অন্যতম প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র গুলোর মধ্যে একটি, ষোড়শ
শতকের ‘গোরক্ষ বিজয়’ কাব্যে মাদলের উল্লেখ পাওয়া যায়। মৃদঙ্গের মতো মাদলও মাটির তৈরি, তবে
কিছুটা স্থুলাকার।আদিবাসী সাঁওতালদের
মধ্যে এবং ঝুমুর নাচ-গানে এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা হয়।
ডুগি বা বায়াঃ
বাঁয়া বাটির
আকারবিশিষ্ট একটি যন্ত্র। এর মুখে
চামড়ার ছাউনি থাকে। বাউলরা
বামপাশে কোমরের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে বাম হাতের তালু ও তর্জনী দিয়ে এটি বাজায়।
কোন কোন অঞ্চলে
এটি ‘ডুগি’ নামেও পরিচিত। একে তবলার লৌকিক সংস্করণ বলা যায়।
তবলাঃ
উপমহাদেশীয় বাদ্যযন্ত্রে তবলার সংযোজন মুসলমানদের
মাধ্যমে। বলা হয় ১৩০০
খ্রীষ্টাব্দে সম্রাট আলাউদ্দীনের সময় পারস্যেদশীয় কবি ও সঙ্গীতবিদ আমীর খসরু তবলা
আবিষ্কার করেন। তবলাকে তলমৃদঙ্গও বলা
হয়। সুরের তাল-লয় ঠিক রাখাই তবলা ও বাঁয়ার উদ্দেশ্য।
তথ্যসূত্রঃ
ওয়াকিল আহমদ, লোকসংস্কতি, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি,
২০০৭, ISBN: ৯৮৪ ৩০০ ০০৯৬৬।
নীহাররঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর ইতিহাস, দে’জ পাবলিকেশন, ১৪০০, ISBN ৮১ ৭০৭৯২৭০৩
শারমিন রেজোওয়ানা
0 মন্তব্য:
Post a Comment