Wednesday, February 7, 2018

জু কিপার/ মাশুদুল হক

সন্ধ্যার দিকে একটু বেড়িয়েছিলাম, টুকটাক কেনাকাটার কাজ ছিল। বাইরে টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। সঙ্গের ছাতাটা পুরনো, দেখতে কিম্ভুতকিমাকার। ছাতা হারানোর ঘটনা এত বেশি ঘটে আমার যে নতুন করে ছাতা কেনাই ছেড়ে দিয়েছি।
পিচঢালা পথটা ভিজে চকচক করছে, ল্যাম্পপোষ্ট, রাস্তার আশেপাশের দোকানপাট, আর গাড়ির হেডলাইটের আলো ভেজা রাস্তায় পড়ে অদ্ভূত এক দৃশ্য তৈরি হয়েছে। বৃষ্টির কারনে রিকশা পাচ্ছিলাম না বলেই এই নিত্য সাধারণ দৃশ্যকেই অন্যরকম মনে হচ্ছে হয়তো।

হঠাৎ বৃষ্টির তোড়টা বেড়ে গেল, পানির ছাট এসে গায়ে লাগা শুরু করলো। আশেপাশে কোন শেড নজরে পড়লো না। দ্রুত সামনে হাঁটা দিলাম। জায়গাটা মিরপুর চিড়িয়াখানার কাছেই, মনে পড়লো সামনেই একটা যাত্রী ছাউনি থাকার কথা, ওদিকেই রওনা দিলাম।

ছাউনীর কাছাকাছি যেতেই বেশ ভয়ার্ত একটা ব্যাপার ঘটলো। চট করে কোথা থেকে একটা মিনি বাস প্রায় গায়ের উপর এসে পড়লো। ড্রাইভার শেষ মুহূর্তে বিকট স্বরে হর্ণ বাজালো, সেই ভয়াবহ কর্ণভেদী শব্দে উল্টা আমি ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে গেলাম, তীব্র হেডলাইট দুটোর আলোয় আমি সম্ভবত সম্মোহিত হয়ে রইলাম। আমি বুঝতে পারলাম, বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যার এ তীব্র আলোই আমার দেখা শেষ দৃশ্য।

এবং শেষমেষ তাই হতো যদি না একজোড়া হাত ঠিক তখনই টান মেরে আমাকে সরিয়ে না দিত।

অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমি কোন কথাই বলতে পারলাম না। জীবনরক্ষাকারী ভদ্রলোকটিকে কোন ধন্যবাদসূচক কথা দূরে থাক, মুখ তুলে তাকিয়েও দেখলাম না। তিনি আমাকে ধরে ছাউনীর বেঞ্চিতে বসিয়ে দিয়েছেন।

‘আপনি কি চিড়িয়াখানা দেখতে এসছিলেন?’ ভদ্রলোক আমি কিছুটা ধাতস্থ হবার পর প্রশ্নটা করলো।

‘না না, আমি বলি, বৃষ্টি দেখে এখানকার ছাউনীতে বসতে এসেছিলাম।’

‘আসলে আপনি না থাকলে যে কী হত...’আমি শেষমেষ বলতে চাইলাম।

‘না ঠিক আছে।’ লোকটার বাংলা কেমন যেন লাগলো, এবার ভালোমত দেখে বুঝলাম ইনি বাঙালি নন হয়তো। বাংলা বেশ ভেঙে ভেঙে বলছেন, কিন্তু নির্ভুল বলছেন।

আমি বললাম, ‘আপনি বাঙালি নন।’

‘হুম, ঠিকই ধরেছেন। কিসে বুঝলেন, ভাঙা বাংলায়?’

‘হ্যা, তাছাড়া আপনার মুখের আদলেও অবাঙালি একটা ভাব আছে।’

তিনি মনে হল বেশ অবাক হলেন, ‘আপনাদের বাঙালিরা তো মিশ্র জাতি, সব ধরনের আদলই আছে আপনাদের। আমার তো ধারনা ছিল অন্তত চেহারায় আমি অবাঙালি সেটা কেউ বুঝতে পারে না।’

‘কতদিন ধরে আছেন এদেশে?’

‘বেশ কিছুদিন ধরে’, হঠাৎ তিনি প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, ‘আপনাদের চিড়িয়াখানাটার তো বেশ বাজে অবস্থা, খানিক আগে আমি ঘুরে ঘুরে ওটা দেখছিলাম।’

আমি কিছু বললাম না, চিড়িয়াখানার কাছাকাছি থাকলেও ওটাতে ঢোকা হয় না বেশ কয়েকবছর, কী অবস্থা কে জানে।

‘চিড়িয়াখানা এমন হওয়া উচিত যেন প্রাণীগুলো বুঝতে না পারে তারা খাঁচায় আছে।’

আমি বললাম, ‘আমাদের দেশে এমনিতেই নানা ধরনের সমস্যা আছে, অত আধুনিক চিড়িয়াখানা করবার জন্য যত জায়গা আর ম্যানেজমেন্ট দরকার সেটা আমাদের নেই।’

‘আরে আপনাদের কথা রাখেন, আমি অনেক দেশেরই বিখ্যাত বিখ্যাত চিড়িয়াখানা দেখেছি, সেগুলোর অধিকাংশই একই অবস্থা, প্রাণীগুলো ঠিকই বুঝতে পারে তারা কারো দেয়া সীমানার মধ্যে আছে।’

চিড়িয়াখানা নিয়ে এ আলোচনা আমার ভালো লাগছিলো না। তিনি বলে চলছেন একমনে,

‘এই কিছুদিন আগেও টরেন্টোর চিড়িয়াখানাটা দেখলাম, বুঝলেন, পৃথিবীর অন্য চিড়িয়াখানা গুলো থেকে অনেক বড়, প্রায় ৭০০ একর জায়গা নিয়ে তৈরি, তারপরও প্রাণীগুলো ঠিকই বুঝতে পারছে তারা যে বন্দী, কী লাভ হল! ফ্লোরিডার অ্যানিমল কিংডম  টা বেশ চেষ্টা করেছে, কিন্তু নাহ! লাভ হয় নাই। তারপর ধরেন...’

আমি বললাম, ‘আপনি পুরো পৃথিবীর চিড়িয়াখানা দেখে বেড়ান নাকি?’

‘না, আসলে চিড়িয়াখানার প্রতি আমার আগ্রহ আছে, আমার কাজের সাথে সম্পর্কিত কিছুটা, তাই যখন যেখানে ডিউটি পরে সুযোগ পেলে সেখানকার চিড়িয়াখানা দেখে নেই!’

আমি মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলাম না, জিজ্ঞেস করলাম, ‘ডিউটি! আপনি আসলে কী করেন?’ একটু থেমে বললাম, ‘অবশ্য বলতে যদি আপনার কোন আপত্তি না থাকে!’

এমন সময় তিনি উঠে দাঁড়ালেন, খেয়াল করলাম যাত্রী ছাউনীর পাশেই একটা প্রাইভেট কার এসে থেমেছে। বেশ আগের মডেলের একটা সেডান।

তিনি হাসি মুখে বললেন, ‘যেতে হবে আমার। আর আমি আসলে একজন চিড়িয়াখানা কর্মী, আমাদের চিড়িয়াখানার জীবজন্তুদের অবস্থা রিপোর্ট করাই আমার কাজ।’

আমি কিছুটা ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে গেলাম।

তিনি গাড়িতে গিয়ে বসলেন, গাড়ির ভেতরটা যতটুকু নজরে এল কেমন যেন অন্যরকম লাগলো। পুরনো মডেলের সাথে ঠিক যাচ্ছে না মনে হল।

দরজা লাগানোর আগে তিনি বললেন, ‘আজকে এখানে আমার ডিউটি ছিল, আর হয়তো কোনদিন দেখা হবে না, ভালো থাকবেন আর হ্যা, সাবধানে রাস্তা চলবেন।’

আমাকে যেভাবে হ্যাচকা টান মেরে লোকটা বাঁচিয়েছে, তাতে বোঝা যায় লোকটা বেশ শক্তিশালী, কিন্তু গাড়িতে উঠবার সময় মনে হচ্ছিল লোকটার হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

কেন যেন মনে হতে লাগলো, দু’পায়ে স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে তাকে বেশ ভান করতে হচ্ছে!

জোর করে ব্যাপারটা মাথা থেকে সরিয়ে দিলাম।

বৃষ্টিটা ধরে এসেছে।


0 মন্তব্য: