Wednesday, February 7, 2018

আমি টাই ও ওয়েস্ট কোট পছন্দ করি



রোলিহ্লাহলা ডালিভুঙ্গা ম্যান্ডেলা ১৯১৮ সালে ১৮ই জুলাই দক্ষিন আফ্রিকার ট্রান্সকিই ভেজো নামে ছোট্ট এক গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন স্কুলেভর্তি হবার পরে প্রথানুযায়ী মিস ডিনগেন তার খ্রীস্টান নাম রাখেন নেলসন ছোটবেলায়বড়দের কাছে বর্নবাদের বিরুদ্ধে তার পূর্ব পুরুষের সংগ্রামের সাহসিককতার গল্প শুনে অনুপ্রানিত হন,সিদ্ধান্ত নেন তিনিও স্বাধিকার সংগ্রাম আন্দোলনে যোগ দেবেন এই সংগ্রামের কারনে তাকে বিশ বছর কারাবাস করতে হয়েছে। কারাবাসে থেকেও তিনি সংগ্রাম পরিচালনা করতেন। তার এই সংগ্রাম ও ত্যাগের ফসল হিসবে কোটি কোটি কালো মানুষের স্বাধিকার অর্জিত হয়। দক্ষিন আফ্রিকা থেকে বর্নবাদ দুর হয়ে প্রতিষ্ঠীত হয় সমান অধিকার ভিত্তেতে সমাজ ও রাষ্ট্র।

১৯৯৪ সালে ১০ই মে দক্ষিন আফ্রিকার ইতিহাসে তিনি প্রথম গনতান্ত্রিক ভাবে জনগনের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তার পরে তিনি আরো অনেক আঞ্চলিক ও আর্ন্তজাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্টানের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে ৬ই ডিসেম্বর এই তেজদীপ্ত অদম্য শান্তিকামী মানুষটি পরলোক গমন করেন।

নিচের সাক্ষাৎকারটি ২০০২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল যখন তিনি প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অবসর নেন। নেলসন ম্যান্ডেলা ৮৪ বছর বয়সে তার বাহারী রঙের শার্ট, সুইট ওয়াইন পান করা এবং তার রোমান্টিকতার সম্পর্কে বলেছিলেন। তিনি এই সাক্ষাৎকারটি তার সকল কর্মি ও মানবমিত্রদের প্রতি উৎসর্গ করেন।

একটি মাত্র বিষয় যা আমি খুবই ভয় পাই তা হলো সকালে ঘুম থেকে উঠার পর আমি জানি না সারাদিন কি করব। এই ভাবনাটা আমাকে মেরে ফেলতো। কারাবাস কালীন দুই দশকের বেশী সময় ধরে রুটিন মাফিক আমি প্রতিদিন ভোর ৪.৩০ মিনিটে উঠতাম। নিজের বডি ক্লক পরিবর্তন করা খুবই কঠিন কাজ।

ঘুম থেকেই উঠে আমি প্রথমে বিছানা গোছাতাম। সকাল ৭টায় নাস্তা সেড়ে আমি খবরের কাগজগুলো পড়তাম। ১৯৪১ সালে এপ্রিল মাসে আমি আমার গ্রাম ছেড়ে ছিলাম কিন্তু গ্রাম কখনই আমাকে ছাড়েনি। যবের মন্ডের সাথে দুধ আর বাদাম দিয়ে আমি নাস্তা করতাম। তারপরে কিছু কিউই ফল আর কলা খেতাম। আমি মনে মনে আমার বয়সকে অনুভব করতাম। আমি তখন আর আশেপাশে দৌড়ঝাঁপ করতে পারতাম না কিন্তু আমি প্রতিদিন ট্রেডমিল ব্যাবহার করতাম।
জেলে যাবার আগে  পোশাকের ব্যাপারে আমি খুবই সচেতন ছিলাম। আমি যে সকল রংচঙা শার্টগুলি পড়েছি সেগুলো ছিল উপহার বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া থেকে। আমি টাই আর ওয়েস্টকোট দিয়ে নিজেকে বেঁধে রাখতে মোটেই পছন্দ করি না।   যখন কোন রাষ্ট্রীয় সম্মেলনে যেতাম এ নিয়ে আমার স্ত্রী গ্রাসার সাথে আমার ঝগড়া হতো। সে বলত, দয়া করে এই কোটটা পড়  আমিও প্রতি উত্তরে বলতাম,  তাহলে আমি নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্টকে কি জবাব দেবো?  

সেক্রেটারি জেলডা আমার শেডিউল গুলো ঠিকঠাক করে দিত। সময়ানুবর্তিতার ব্যাপারে  আমি খুবই কঠোর ছিলাম-এটার কারন হচ্ছে  যার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি তাকে সম্মান দেখানো ছাড়াও পশ্চিমাদের  বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে যে আফ্রিকান মাত্রই দেরী করে আসবে, সেটাকে ভূল প্রমান করতে  দিনে আমার আটটির মত অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকত বার্সেলোনা সম্মেলন থেকে শুরু করে, লকারবিতে  বোমায় ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারদের দেখতে যাওয়া, আর্নল্ড সোয়ার্জনিগারেরে সাথে চা পান করা অথবা দক্ষিন আফ্রিকার স্কোয়াটার ক্যাম্প পরিদর্শন করা- সবই থাকত । যখন আমি কোন স্কুল পরিদর্শনে যেতাম তখন শিশুদের সাথে Twinkle Twinkle Little Star গাইতাম কারন এটা ছিল অনেকটা প্রার্থনার মত, স্বপ্ন সত্য হবার মত 

দুপুরের খাবারের জন্য আমি সব সময় বিরতি নিতাম কিন্তু আমি মনে করি যদি আপনি উৎসাহ নিয়ে কোন কাজ করেন তাহলে আপনি কখনই ক্লান্ত হবেন না। আমি শাক-সব্জী, সালাদ আর সীমের বিচী খেতে পছন্দ করি। এখন আবার মাছ মাংসও ভালো লাগে।  আমি মদ খেতাম যদিও আমি কিছুটা গেঁয়ো ছিলাম কেননা আমি শুধু মাত্র মিষ্টি মদ খেতে পারতাম। জেলে থাকাকালিন শেষের বছর গুলোতে আমার প্রহরী ছিল একজন আফ্রিকান শ্বেতাঙ্গ এবং সে একজন চমৎকার মানুষ ছিল। আমাকে ও বার বার বলত দেখ, সব সময় তুমি মিষ্টি মদ কেনার জন্য আমাকে বাইরে পাঠাও। ভদ্রলোকেরা ড্রাই ওয়াইন পান করে 

১৯৮৩ সালে আমাকে যখন রোবেন আইল্যান্ড থেকে কেপ টাউনের পোলস্‌মুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয় তখন ওরা আমাকে আমার স্ত্রীর উইনির সাথে দেখা করার অনুমোতি দিয়েছিল সেখানে আমাদের বিচ্ছিন্ন করার জন্য কোন কাঁচের দেয়াল ছিল না। আমি ওকে চুমু খাই, তার হাত দুটোকে ধরি। এমন একটা মূহুর্তের জন্য আমি হাজারো স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমরা দুজনেই ছিলাম চুপ চাপ, শুধু মাত্র আমাদের হৃদয়ের স্পন্দনের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ২১টি বছর পরে আমি ওর হাত ধরলাম। পরে আমরা নিজেদেরকে ঐ বন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নেই। সে একজনকে বিয়ে করেছিল যে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাকে ছেড়ে চলে যায়। এক সময় সেই মানুষটি হয়ে যায় কিংবদন্তী, সেই কিংবদন্তী একদিন বাড়ী ফিরে এসে প্রমান করে সে রক্তে মাংসে গড়া একজন সাধারন মানুষ। আসলে মুক্তিকামী যোদ্ধাদের ভাগ্যে ব্যাক্তি জীবন দৃঢ় হয় না।

আমি কি রোমান্টিক? 

বিশেষ করে তরুন বয়সে আমি প্রেমে বিশ্বাস করতাম। আপনি লক্ষ্য করে দেখুন আমার বাবা কিন্তু বহুবিবাহ করেছেন। তার চার স্ত্রী ছিল। আমি মনে করি মানুষ যেকোন বয়সে তার আত্মার সঙ্গির দেখা পেতে পারে। আমি এক প্রেমময়ী নারীকে বিয়ে করেছি এবং কখনই তাকে ছাড়া অন্য কাউকে চিন্তাও করিনি। সে তার নিজ দেশ মোজাম্বিকে বাস করে কিন্তু সে আমাকে দেখতে আসে আর আমিও তাকে দেখতে যাই।  যখন আমরা এক সাথে থাকি না তখন আমরা দিনে দুবার কথা বলি।

অনেক বিষয় আছে যেগুলো আমার মেজাজ বিগড়ে দেয়। তা সত্ত্বেও আমি বাইরে থেকে শান্ত ছিলাম। উদাহরন স্বরুপ বলতে পারি এইডসে্‌র চিকিৎসার ব্যাপারটা। আমি এক ফার্মাসিটিউক্যাল কোম্পানিকে বলেছিলাম শহরের বাইরে একটা ক্লিনিক স্থাপন করতে।

একটি বাজে ঘটনা ঘটেছিল যা ছিল হৃদয় বিদারক এবং আমার জন্য কঠিন। জনেন্দ্রিয় ও ব্লাডার কাটা অবস্থায় এক তরুন ঘাসের উপর পড়েছিল। আমি দেখলাম ডাক্তারটি ছিল যেমন হীনমনা তেমনি বাজে ছিল তার চিকিৎসা পদ্ধতি। আমি ঐ ছেলেটির জন্য টাকা পয়সা যোগাড় করলাম এবং আমার ব্যাক্তিগত ইউরোলজিস্ট ঐ তরুনটির অপারেশন করেছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল কারন কিছু কিছু মানুষ মুতিতে  ( এক ধরনের আফ্রিকান ঔষধ যেখানে কালো যাদুর মানুষের অঙ্গ ব্যাবহার করা হয় ) বিশ্বাস করত। আমি এসবে কখনই বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু আমি স্বীকার করি যে ধর্মে রয়েছে  একটি শক্তিশালী শৃংখলনীতি। এবং আপনাকে সকল ঝূঁকিকে এড়িয়ে যেতে হবে।

আমি রাত ৯টায় ঘুমোতে যাই। যদি আপনার অবস্থা দুর্দশাগ্রস্থ হয় তাহলে আপনি স্বপ্নে ভৌতিক কিছু দেখতে পারেন। কিন্তু আমি সব সময় পজিটিভ ছিলাম। এমনকি যখন আমি একা ঘুমাতাম তখনো। আমি ভয়ে পিছপা না হওয়ার চেষ্টা করতাম। আমি আমার আত্মজীবনীতে লিখেছিলাম যে মানুষ বড় একটি পাহাড় বেয়ে ওঠার পরে একটা গোপন তথ্য জানতে পারে যে সামনে আরো বড় বড় পাহাড় রয়েছে যেগুলোকে বেয়ে উঠতে হবে। আমি ক্ষনিকের জন্য বিশ্রাম নিতে পারি, স্বাধীনতার সাথে আসে অনেক অনেক দায়িত্ব। আর আমি লম্বা পথ পাড়ি না দিয়ে বিলম্ব করার  সাহস করতে পারি না। 


0 মন্তব্য: