একটা সময় ছিল যখন
পত্রিকার পাতা খুললে নতুন সিনেমার বিজ্ঞাপন পাওয়া যেত।কোন্ পেক্ষাগৃহে কোন্
চলচ্চিত্রটি চলছে, কত সপ্তাহ ধরে চলছে এই বিষয় গুলো জানার কৌতুহল সমাজের সব
শ্রেণীর পেশাজীবি মানুষের ছিল। সিনেমা ভিত্তিক ম্যাগাজিন গুলোর কাটতি ছিল প্রচুর।
স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা শেষ পরীক্ষাটি দেয়ার পরেই সবাই দল
বেঁধে স্থানীয় প্রেক্ষাগৃহ গুলোতে হুমড়ী খেয়ে পড়ত। টিকিট কাটা ছিল রীতিমত
বিভীষীকাময় এক অধ্যায়। প্রতিটি বন্ধুচক্রের কোন একজন সচতুর চটপটে বন্ধুর উপর এই
বিশেষ দ্বায়িতটি ন্যাস্ত করা হতো। শুধু এই কারনেই বন্ধমহলে তার একটি বিশেষ অবস্থান
থাকত। স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে চুপিচুপি সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার প্রবনতা ছিল
ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে।
প্রতিটি প্রেক্ষাগৃহে
থাকত উপচে পড়া ভীড়। এমনও দেখা গেছে সীমিত আসন সংখ্যার বাইরে আলাদা কাঠের চেয়ার
বসানো হতো। টিকিট কালোবাজারীদের দৌড়াত্ব সামলাতে হীমসীম খেতো প্রেক্ষাগৃহের
মালিক ও কর্মচারীরা। প্রতিমাসে স্বপরিবারে সবাই মিলে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা উপভোগ
করার একটা রেওয়াজ ছিল। প্রিয় নায়ক-নায়িকদের সাক্ষাৎকার সবাই আগ্রহ নিয়ে পড়ত।
ভক্তরা তাদের পছন্দ অপছন্দের সব খুঁটিনাটি বিষয়গুলো খোঁজ খবর রাখত। রেডিও
টেলিভিশনে সিনেমা ভিত্তিক অনুষ্ঠান গুলো অনেক জনপ্রিয় ছিল। সিনেমার গান নিয়ে
অনুষ্ঠাণ “ছায়াছন্দ”তখন বিটিভি’র অন্যতম জনপ্রিয় অনুষ্ঠান গুলোর একটি। সেসময়
সামাজিক জীবনে এদেশে চলচ্চিত্রের প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট।
কালের আবর্তে আজ সব
হারিয়ে গেছে। সব কিছু আজ আরব্য রজনীর গল্পই মনে হয়। আজ আমাদের চলচ্চিত্র নিয়ে তরুন
সমাজের কোন আগ্রহ নেই। নেই সেই আগের উন্মাদনা। অথচ এমনটা হবার কথা ছিল না।
আজ আমাদের চলচ্চিত্রের এই রুগ্ন করুন অবস্থা কেবল আফসোস আর হারাবার কষ্টই যোগায়।
চলচ্চিত্রকে বলা হয়
সবচেয়ে শক্তিশালী গনমাধ্যম। চলচ্চিত্রকে বিবেচনা করা হয় সমাজের দর্পন। পৃথিবীর
প্রতিটি সমাজ ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে চলচ্চিত্র।
একটি সমাজ ; শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে কতটা সমৃদ্ধ তারই দূত হিসেবে কাজ করে চলচ্চিত্র।
স্বাধীনতার পূর্বকালীন
আমাদের চলচিত্র রেখেছিল বিশেষ ভূমিকা।স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে সত্তর দশকের মাঝামাঝি
সময় থেকে এদেশের চলচিত্রের বানিজ্যিক উত্থান ঘটে। তখন টেলিভিশন সেট আজকের মত সহজ
লভ্য ছিল না। দেখা যেত কোন বাড়ীতে টেলিভিশন থাকলে সেখানে পুরো মহল্লার মানুষ এসে
জড়ো হতো। তবে বিনোদনের সহজ লভ্য হিসেবে সিনেমা ছিল মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের
প্রথম পছন্দ। সেই সময়ের দেশীয় সিনেমার আকাশ ছোঁয়ার জনপ্রিয়তার কারনের মূলে এটা ছিল
না। সত্তর, আশি ও নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ের সিনেমা গুলো পর্যালোচনা করলে দেখা
যায় সেই সময়ের চলচিত্র গুলো সমাজের সকল শ্রেনীর মানুষের বাস্তব জীবনের টানাপোড়ন,
আশা, আকাঙ্ক্ষা, হতাশা, আনন্দ,সুখ, দুঃখের সাথে স্বপ্নময় ও কাল্পনিক জগতের একটি
অপূর্ব শৈল্পিক মিল বন্ধন ছিল। ঐ সময়ের চলচ্চিত্র গুলো সাধারন মানুষের কল্পনা
জগতকে বিশেষভাবে আন্দোলিত করতে সক্ষম হয়েছিল। তখনকার চলচ্চিত্রে প্রযুক্তিগত
সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা থাকা সত্ত্বেও নির্মান শৈলীতে যঠেষ্ট নান্দনিক
শৈল্পকিতার ছাপ থাকত। অথচ বেশীর ভাগ কলা কুশলীদের চলচ্চিত্র বিষয়ক তেমন কোন
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহন করার সুযোগ ছিল না। প্রতিটি শিল্পীর অভিনয় সম্পর্কিত
ব্যাবহারিক জ্ঞান ও দক্ষতা ছিল দীর্ঘদিনের সাধনা, আত্মত্যাগ, গভীর মনোনিবেশ, কাজের
প্রতি শ্রদ্ধা ও আত্মনিয়োগের ফসল। তাই তাদের অভিনয় মানুষের হৃদয়ের খুব কাছে চলে
যেতে পারত। পর্দায় প্রতিটি অভিনেতা অভিনেত্রী দর্শকের কাছে তাদের চরিত্র গুলোকে
বাস্তব ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন।
তাহলে বর্তমানে
প্রজন্মের কাছে এ দেশীয় চলচিত্র কেন হারোনা অতীত গৌরব হাতড়ে বেড়াবে? বিষয়টিকে
গভীর ভাবে পর্যবেক্ষন ও গবেষণার মধ্য দিয়ে এখনি এর উত্তরণের পথ বের করতে হবে।
কোন একক কারনে আজকের
এমন করুন পরিণতি নয়। এর মূলে রয়েছে নিতি নির্ধারকদের অদুরদর্শিতা ও
অপরিণামদর্শিতা। স্বাধীনতা পরবর্তী কালীন সময়ে ছিয়াত্তর সালের দিকে এদেশের মানুষের
সাথে বিদেশী চলচ্চিত্রের পরিচয় ঘটে। তখন বিটিভিতে “মুভি অব দ্যা উইক” এ হলিউডের ইংরেজী সিনেমা গুলি প্রচারিত
হতো। ভারতীয় বাংলা সিনেমা প্রচারিত হত নিয়মিত ভাবে। তখনকার প্রেক্ষাপটে এই উদ্যোগ
ছিল প্রশংনীয় যা পরবর্তীতে এদেশের চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। আশি দশকের
মাঝামাঝি সময়ে ৮৩/৮৪ সালের দিকে বাংলাদেশে ভিডিও ক্যাসেট রেকর্ডার(VCR) এবং ভিডিও
ক্যাসেট প্লেয়ার(VCP) বানিজ্যিক ভাবে আমদানী শুরু হয়। তখন থেকেই মূলত বৈধ ও অবৈধ
উপায়ে বাংলাদেশে বিদেশী চলচ্চিত্রের প্রসার ঘটে বিশেষ করে হিন্দি সিনেমার। প্রতিটি
পাড়া, মহল্লা, গ্রামে গঞ্জে, শহরের অলিগলিতে গড়ে ওঠে অসংখ্য ভিডিও লাইব্রেরীর
দোকান। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ভিডিও ক্যাসেট তখনো বানিজ্যিক ভাবে বাজারের ছাড়া
হয়নি। কেন হয়নি সেটাও একটি বড় প্রশ্ন। সে সময়েও এখানকার মতো হলিউড বলিউডের
সেলুলয়ডের ফিল্মের সিনেমা গুলো মুক্তির কয়েক মাস পরে ভিডিও প্রিন্ট বাজারের ছাড়া
হতো। কিন্তু দেশে বাজার থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে তা কখনই হতো না। আর এই
ঘাটতি দখল করে হিন্দি সিনেমা গুলো। ভাষাগত ভাবে হিন্দি ভাষা বোঝা সহজতর হবার কারনে
এদেশের মানুষের কাছে হিন্দি ভাষার সিনেমা গুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যার ফলে এদেশের
চলচ্চিত্র গুলো একটা অনাকাঙ্খিত অসম প্রতিযোগিতার পরে যায়। আশির দশকের মাঝামাঝি
থেকে হিন্দি ছবি গুলোর একটি কপি থেকে হাজার হাজার কপি করা হতো। আবার সেই কপি থেকে
খুচরা ভিডিও লাইব্রেরীর ব্যাবসায়ীরা লাখ লাখ কপি করে ব্যাবসা চালত। এই অপকর্ম করা
হতো কপি রাইট আইনের নীতিমালা ভেঙ্গে। ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৬২ এর
অর্ডিন্যান্সের ইনটেলেকচুয়্যাল প্রপাটির ল’র অধীনে ছিল কপিরাইট আইনটি। যা মেধাস্বত্ত আইন
নামেও পরিচিত। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে এই আইনটির আর কিছু সংযোজন বিয়োজন করে
প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু অন্যন্যা অনেক আইনের মত এই আইনটির বাস্তব ব্যাবহার না হওয়ার
সুযোগে আমাদের সমাজের সর্ব স্তরে হিন্দি চলচ্চিত্র পৌঁছে যায়। যার ফলে আশির দশকের
শেষে ও নব্বই দশকের শুরু দিক থেকে আমাদের চলচ্চিত্রের বাজার অনেকাংশে দখল করে নেয়
ভারতীয় চলচ্চিত্র গুলো। যদিও বাংলাদেশের কোন প্রেক্ষাগৃহে ভারতীয় সিনেমার
প্রদর্শনের অনুমোতি পায়নি। কিন্তু তা স্বত্তেও আমরা ভারতীয় চলচ্চিত্রের কাছে থিতু
হয়ে পড়ি। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রেও।
নববই সালে এদেশের
বানিজ্যিক চলচ্চিত্রগুলোতে হিন্দির সিনেমার গল্প ও গানের প্রভাব দেখা যায়। ততদিনে
ভিসিপি এবং ভিসিআর বাংলাদেশে সহজলভ্য হয়ে উঠে।প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে হিন্দি
সিনেমা। শহর থেকে গ্রামে সবর্ত্র হিন্দি সিনেমা আমাদের সামাজিক জীবন প্রভাব ফেলতে
শুরু করেছে। তখনো স্যাটেলাইট টিভি’র প্রচলন শুরু হয়নি কিন্তু ততদিনে আমরা আমাদের
নিজস্ব বাজার হারিয়ে ফেলেছি। নিজস্ব স্বকীয়তা হারালে সামাজিক জীবনেও তার প্রভাব
দেখা যায়। এদেশের নীতি নির্ধারকরা সেসকল বিষয়গুলো নিয়ে কখনই কাজ করেনি। কিভাবে
ধীরে ধীরে আমাদের সংস্কৃতি ধবংস হচ্ছে তা দেখেও না দেখার মত করে উপেক্ষা করেছেন
স্বাধীনতা উত্তরনকালীন প্রায় প্রতিটি সরকার।
নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়ে
স্যাটেলাইট টিভি’র প্রসার ও প্রচার ঘটে। এবং তা খুবই অল্প দিনের মধ্যে বাংলাদেশের
স্থায়ী আসন করে বসে। বাংলাদেশে হিন্দি সিনেমা এর আগে থেকে পাকাপোক্ত আসন করে
ফেলেছে তার উপর স্যাটেলাইট টিভি’র আগমন এদেশের চলচ্চিত্রকে আরো ধবংসের
দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। তখনো বাংলাদেশে কোন স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ছিল না। তা
সত্ত্বেও এর বাজারকে নিয়ন্ত্রন না করে বরং এর প্রসারে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে
দেশের উচ্চ মহলের কর্তা ব্যাক্তিরা।
মূলত দেখা যায় এদেশের
চলচ্চিত্রের অধঃপতন নিশ্চিত হয়েছে সুদর্শন নায়ক সালমান শাহ্ এর আকস্মিক মৃত্যুর
পরে। হিন্দি সিনেমা দৌড়াত্বের যখন মধ্য বিত্ত শ্রেনী এ দেশের চলচ্চিত্র থেকে
পুরোপুরি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। তখন সালমান শাহ্ তরুন তরুনীদের মাঝে একটা উন্মাদনা
সৃষ্টী করতে পেরেছিল। তার সাবলীল অভিনয়, বাচন ভঙ্গী, শারিরীক ভাষা, ফ্যাসন, স্টাইল
সবাইকে আকৃষ্ট করেছিল। কিন্তু তার মৃত্যুর পর পর এদেশের চলচ্চিত্রের মৃত্যু
হয়ে যায়। চরম ভাবে অনৈতিকতা আর অশ্লীলতা দখল করে নেয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে।
ব্যাপক দূর্নীতি অনিয়মের বেড়াজালের এ দেশের চলচ্চিত্রের ব্যাপারে সাধারন মানুষের
আগ্রহ ও কৌতুহল সম্পূর্ন হারিয়ে যায়। তারপরেও যদি আমাদের সচেতনা সৃষ্টি না হয়
তাহলে চলচ্চিত্রের মত এই বিশাল শিল্প ও বাজারটি আমাদেরকে অন্যের হাতে তুলে দিতে
হবে। তবে আশার কথা হচ্ছে এখনো কিছু কিছু তরুনের মাঝে চলচ্চিত্রের ব্যাপারে ব্যাপক
আগ্রহ রয়েছে। তারা বিভিন্ন প্রশিক্ষন গ্রহন, কর্মশালায় অংশ্রগ্রহন, এমনকি বিদেশী
গিয়ে চলচ্চিত্র বিষয়ক পড়াশুনাও করছেন। তাদেরকে শ্রম ও মেধা বিকাশের জায়গাটা করে
দিতে হবে আমাদের। হর্তা কর্তা ব্যাক্তিরা যদি এখনো ঘুমিয়ে থাকেন তাহলে বাংলাদেশের
চলচ্চিত্রের সুদুর প্রসারী ভবিষ্যৎ বলে কিছুই থাকবে না।
0 মন্তব্য:
Post a Comment