Wednesday, May 17, 2017

জিয়ন কাঠি - সীমা কর




পৃথিবীর আলো বাতাস দেখার আগেই আমার গর্ভের প্রথম ছেলে সন্তানটি মারা যায় , তার প্রায় দুই বৎসর পর আমার একটি মেয়ে হয় । কন্যা সন্তানটিকে বুকে জড়িয়ে নিজেকে মনে হতে লাগল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জননীর সেই মা । আবহমান বাংলার চিরায়িত সেই মায়ের রূপের ছটা আমার শিরায় উপশিরায় তরঙ্গায়িত হতে লাগলো প্রতিটি মুহূর্তে ,আমাকে আমার মাঝে নতুন করে আবিস্কার করার পুলকে আমি বিহব্লিত  চাঁদ ,তারা ,আলোর মধ্যেখানে আমার  কন্যার মুখটিই তখন আমার পৃথিবী । অথচ এই সুখের অনুভূতি ফিকে হয়ে যায় যখন দেখি চারপাশের মুখের রং গুলি কালো । যারা পরম বন্ধু ,আত্মার আত্মীয় সেই মানুষগুলো প্রায়শই বলতো , ‘ তোর মেয়ে হবে রে !। যেনো এক বিশাল বড় বিপদ আমার সামনে অপেক্ষা করছে , কালো মেঘের আভাস আমার ললাটে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সেই কারনেই আমার ভালোবাসার মানুষদের কপালে চিন্তার ভাঁজের মাত্রাটাও মাত্রাতিরক্ত । লিঙ্গ বৈষম্যের অদৃশ্য কালো দীঘির জল আমার বুকেও কি ছলাৎ ছলাৎ করে শব্দ করেনি । করেছে তো । আমি সেই অদৃশ্য জলের নদীতে বৈঠা বেয়েছি নিরন্তর । বহু বছর পর কন্যার মুখে নিজের ছায়ার রূপ দেখে আমি আপন মনে এক অলিখিত সনদে স্বাক্ষর করেছি ;আমার নবজাতকের জীবনে গ্রহণের কালো ছায়া আসতে দিবো না  সে শুনবে না কোন ও গোপন জলের শব্দ ।

 নিজের ইচ্ছাশক্তিতে জানতে শিখেছি প্রীতিলতার কথা , বেগম রোকেয়ার কথা , উপলব্ধি করেছি শহীদ জননী জাহানারা ইমাম , ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী সহ একাত্তরের নারীদের সংগ্রামি জীবনের বন্ধুর পথকে। ছুটে গিয়েছি সীমানা ডিঙ্গিয়ে রানী লক্ষ্মী বাই , ইন্দিরা গান্ধী , মাদার তেরেসা , ফ্লরেন্স নাইটিঙ্গেল , মাদাম কুরি , ভেলেনতেনা তেরেস্কোভা ,কল্পনা চাওলা , সুনিতা উইলিয়াম তাদের জীবনের আঙ্গিনাতে । ভেবেছি এরাই আত্মার পরম আত্মীয় আমার । সমস্ত পৃথিবীটা ঘুরে এলে আমার এমন আত্মীয় অনেক ; কাকে রেখে কার কথা বলি  বললেও বলা ঠিক ঠিক মতো হল কিনা , কতো কম ; কতো বেশি হবে এ ভাবনায় মনকে শুধু তাড়িয়ে বেড়ায় । নারী একদিন যোগী সেজেছিলও ,সতীত্বের প্রমান দিতে রুপকথার নারীকে সমাজ ঘর থেকে বাইরে এনেছিলও । পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে তৈরি মানুষের লীলা সঙ্গী সেদিন তাই স্বামীর জীবন ফিরিয়ে দিয়ে ইতিহাসে নারী জীবনকে জয় মাল্য পরিয়েছিল পরম আদরে । বাস্তবের নারী স্বর্গের নর্তকী থেকে হয়ে গেলো পৃথিবীর ডাইনী ,সে আর বেহুলার মতো জীবনের জয়মাল্য গলায় পরতে পারলো না । তার বদলে তাকে খাওয়ানো হলো আফিম ; স্বামীর পরলোক গমনে আফিমের গন্ধে নাক মুখ ডুবিয়ে জীবন্ত আগুনে পুড়ে তাকেও করতে হল অগস্ত যাত্রা । আর বেঁচে গেলেও সে হল  সেবাদাসি , সে হলও  লুটের মাল , তাকে ভাগ করা যায় নানা ভাগে । তাকে নিয়ে শুরু হল  যোগ বিয়োগের হিসাব । বহুমাত্রিক অপমান ,অনির্ধারিত নির্যাতন আর নিষ্পেষণে কখনো সে অন্দরমহলের রঙ মঞ্চের নটি বিনোদনী , কখনো ঘরের অলংকার; ফুলদানীর ফুল কেবল জীবন্ত নারী সমাজের অভিশাপ । তবু কি নারী বসে আছে কষ্টের ভিতর ? যন্ত্রণার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েই বন্ধুর পথের আলোকবর্তিকা হয়েছে এই নারীই । পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্যের আঁধার নারী শক্তির ভেতর থেকেই বেড় হল নারী জীবনের অস্তিত্বের লড়াই  জীবনের সংগ্রামের পথই হল নারীর পরম বন্ধু । অস্তিত্বের দাবী নিয়ে নারী পথে নামলো ,সে পুরুষের পাশে বসে ইট ভাঙে , রিক্সা চালায় ,হিমালয়ে যায় , এমনকি অসুর্যস্পর্শারা এখন মহাকাশেও যায় মানুষের সমান দক্ষতায় । মহাকাশ থেকে ফিরে এসে দেশ চানালোর মহাশক্তিও তার ভেতরে জন্মায় সেকি কোন ভিন গ্রহের আশীর্বাদে ? না কি পথের শক্তি থেকে একটু একটু করে সিঞ্চিত রস তার পরতে পরতে জমে তাকে করে তুলল উর্বর , সে হলো মহাকালের সাক্ষী ।

কবির অভিযোগ ছিল বিধাতার কাছে নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার অধিকার তিনি কেনও দিলেন না , হায় সে বিধাতা যে স্বর্গে নয় , মর্তে; কবি কি তা জানতেন ? আর সে পুরুষ বিধাতা বিনা যুদ্ধে নাহি দিবে সুচাগ্র মেদেনি  পুরুষ যে জগতে যুগে যুগে এসেছে , প্রতিবার নারীকে কাঁদিয়েই এসেছে । তবু তার অহংকার সে পুরুষ।                                                                        
 যে পুরুষ নারীকে ডাইনি রুপে কল্পনা করেছে সেই বংশলতিকা কখনই নারীকে ভালবাসেনি , শ্রদ্ধা করেনি , মানুষ ভাবেনি । যে পুরুষ নিজের সত্ত্বাকে শক্তির কাছে ম্লান করেনি , নিজেকে আর নারীকে ভেবেছে পাশাপাশি মনুষ্য প্রকৃতি সে যুগে যুগে ভেঙ্গেছে নারীর অর্গল , খুলেছে নতুন দুয়ার । নারী এতদিন ছিল পুরুষের পথের মঙ্গল দীপ ,এখন তার পথেও যে কেউ একজন মঙ্গল দীপ জ্বালাবে সেই যুগ তো এসেছে । নারীর নব জাগরনের উৎসব হয় এখন ঘরে ঘরে । মাতৃত্বের সত্যিকে মেনে নিয়ে একদিন নারী ভালোবেসেছিল গৃহ , সেই গৃহ তাকে বাষ্পীয় সম্মান দিয়েছে কিন্তু বাস্তব অধিকার দেয়নি । যখন তার অধিকার আদায়ের সময় হল তখনই জানলোও সে শক্তির জোরে পৃথিবী পরাস্ত । এখন একই পৃথিবীতে সে তার অধিকার আদায় করে নিয়েছে । পুরুষের বহু পিছনে দাঁড়িয়েও সে পৌঁছে গেছে তার কাংখিত লক্ষ্যে। ইট ভাঙ্গা নারীর ঘর্মাক্ত হাত ,আর নভোচারী নারীর কর্মের মহোৎসব মিলে যাক কাজের হোমযজ্ঞে । কর্মই নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দিয়েছে। 
    

যে মেয়ে শিশু আজ জন্ম নিল তাকে আমি দুহাত বাড়িয়ে বরণ করি পরম আনন্দে । তাকে আশীর্বাদ করি যেন তার আগমনে ধরণীর ধুলি রঙিন হয়ে উঠে । সেই আনবে আরেক নতুন দিন । নতুন যুগের শুভ সূচনা হোক তার পায়ের চিহ্ন এঁকে ।    

লিখেছেন - সীমা কর


0 মন্তব্য: